১৩ জানু, ২০১৮

মানুষের বৈশিষ্ট্যের মূলে জিন, জিন বিন্যাসের মূলে গ্রহ-নাক্ষত্রিক প্রভাব, আর গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ন্ত্রিত হয় স্রষ্টার বেধে দেয়া নিয়মে।



মানুষে মানুষে যতই মিল থাকুকনাকেন বেমিল তথা পার্থক্য থাকবেই। এই পার্থক্য যেমন আকার-আকৃতি রূপ-লাবণ্যের, তেমনি চলার ছন্দ আচরণগত, তেমনি চিন্তা-চেতনা মানসিকতার। এগুলি বলে শেষ করার নয়। বিজ্ঞানীরা এই পার্থক্যের দুটি প্রধান কারন নির্দেশ করেছেন- বংশগতি (Heredity) পরিবেশ (Environment) বংশগতি বলতে পিতা-মাতা বা উর্দ্ধতন হইতে যাহা প্রাপ্ত তাহাকে বুঝায়। শিশু যাহা লইয়া জীবন আরম্ভ করে তাহাই বংশগতি। এর দ্বারাই ব্যক্তির জন্মগত দৈহিক মানসিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। শিশু যখন জন্মগ্রহন করে তখন তাহার জীবন আরম্ভ হয়না, তাহার জীবন আরম্ভ হয় মায়ের গর্ভধারনের সময় থেকেই। আর বংশগতির প্রবণতা মানুষের আয়ুষ্কাল অবধি চলতে থাকে। পরবর্তীতে এই বিষয়ে তত্ত্বগত প্রমান দেয়ার চেষ্টা করব 

পরিবেশ বলতে বুঝায়- জন্মস্থানের ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য, খাদ্য, গৃহ, সমাজ, ধর্ম, পারিপার্শ্বিকজন, শিক্ষা ইত্যাদিকে। বংশগতি শিশুর জন্মের সহিত তাহার স্বভাবের মধ্যেই নিহিত থাকে বলে বংশগতিকে প্রকৃতিও বলা হয়ে থাকে। আর পরিবেশ শিশুর প্রকৃতিগত নয়, অবস্থা হিসাবে তাহার সহিত অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত থাকে। পরিবেশও তখন হইতেই আরম্ভ হয়, যখন মাতৃগর্ভে ভ্রূণের প্রথম সঞ্চার হয়

জীববিজ্ঞানীদের মতে- প্রত্যেক জীব এবং প্রত্যেক মানুষ দুই শ্রেণীর কোষ দ্বারা গঠিত। দেহকোষ (Body-Cell) এবং জননকোষ (Germ-Cell) বংশগতি জননকোষের সহিত সম্পর্কিত। প্রত্যেকটি প্রাণী সবসময় একটি করিয়া সজীব ডিম্বানু হইতে জীবন আরম্ব করে। মাতার ডিম্বানুর মধ্যে পিতার শুক্রকীট প্রবেশের ফলে মাতৃগর্ভে এককোষবিশিষ্ট (Unicellular) জীবকোষ (Zygot) সৃষ্টি হয়। ইহাই ভ্রূণের প্রথম সঞ্চার। প্রাকৃতিক নিয়মে মাতৃগর্ভের সজীব ডিম্বানু দ্বিধাবিভক্ত হইয়া দুইটি স্বতন্ত্র জীবকোষে পরিণত হয়। এই সময়ে উভয় জীবকোষ পিতা-মাতার জননকোষ হইতে সমসংখ্যক (মোট ২৪ জোড়া) ক্রোমোজোম লাভ করে। এই জীবকোষও দ্বিধাবিভক্ত হইয়া ক্রমশ বহু জীবকোষের সৃষ্টি করে। জীবকোষের সংখ্যা বৃদ্ধি জ্যামিতিক অনুপাতে ঘটিয়া থাকে

এই জীবকোষ এতই ক্ষুদ্র যে তাহা খালিচোখে দেখা যায়না, দেখতে হলে শক্তিশালী অনুবীক্ষণযন্ত্রের প্রয়োজন হয়। জীবকোষের বাহিরের আবরণকে বলে কোষপ্রাচীর। এই কোষপ্রাচীরের মধ্যে থাকে প্রোটোপ্লাজম প্রাণকেন্দ্র (Nucleus) প্রোটোপ্লাজম সজীব এবং কিছুটা ঘনীভূত তরল পদার্থ। আর প্রাণকেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস হইল একজাতীয় অস্বচ্ছ গাঢ় উপাদানে তৈরী এক গোলাকার পদার্থ। নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকে সুতারন্যায় ৪৮টি সূক্ষ্ম পদার্থ- যাদের নাম ক্রোমোজোম (Chromosome) এগুলি জোড়ায় জোড়ায় থাকে। তাদের অর্ধেক মাতৃকুল অর্ধেক পিতৃকুল হইতে আসে। অর্থাৎ ২৪ জোড়া ক্রোমোজোমের একটি পিতা এবং একটি মাতা হইতে আসিয়াছে বলিয়া প্রত্যেকটিতেই পিতা-মাতার দেহের উপাদান বিদ্যমান থাকে। তারমধ্যে ২৩ জোড়া A ক্রোমোজোম এবং একটিতে XY ক্রোমোজোমের আবির্ভাব ঘটিলে নর, আর ২৩ জোড়া B ক্রোমোজোম এবং একটিতে XX ক্রোমোজোমের আবির্ভাব ঘটিলে নারী শিশু জন্মায়। তার মানে ২৪ জোড়া ক্রোমোজোমের মধ্যে ২৩ জোড়া নারী-পুরুষের জন্য সমান এবং ২৪তম জোড়ার মধ্যেই লিঙ্গ নির্ণয়কারী পার্থক্য XY অথবা XX ক্রোমোজোম থাকে। উল্লেখ্য যে, একমাত্র পুরুষের জননকোষেই X Y উভয় ধরনের ক্রোমোজোম থাকে বলিয়া লিঙ্গ নিরূপণের ক্ষেত্রে পুরুষের জননকোষই প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে। প্রসঙ্গতঃ যে নারীকে এজন্য যুগে যুগে কত মূল্য দিতে হয়েছে নারী শিশু জন্মদানের অপরাধে! আরও উল্লেখ্য যে, একটিমাত্র X অথবা একসঙ্গে দুইটি X একটি Y কিংবা একসাথে একটি X দুইটি Y ক্রোমোজোম থাকিলে নপুংসক জন্মায়। সোবহান আল্লাহ্! যারা জন্মদাতা-দাত্রী মনে করেন নিজেদেরকে তারা একটু ভেবে বলুন X বা Y ক্রোমোজোম কি নিজেদের ইচ্ছা মাফিক সমন্বয় করতে পারবেন, নাকি আল্লাহ্ পাকের ইচ্ছায় হবে ?

এই ক্রোমোজোমের মধ্যে অবস্থিত জিনস্ (Genes) বংশগতির মূল উপাদান। জিনগুলি নানা প্রকার রাসায়নিক উপাদানের সংমিশ্রণে গঠিত। জিনও জোড়ায় জোড়ায় অবস্থান করে। নর-নারীর প্রতিটি জননকোষে ৫০৪ জোড়া জিন থাকে। এই জিনগুলি বিভিন্ন ক্রোমোজোমের মধ্যে একটি যোগসূত্র স্থাপন করে বলে ক্রোমোজোমগুলিকে একটি মালা বা তসবিহের মত দেখায়

শিশু জন্মগ্রহণের পূর্বেইজেনিযৌনগ্রন্থির বিকাশ নিয়ন্ত্রণ করিয়া থাকে। পরবর্তীকালে যৌনগ্রন্থি হইতে ক্ষরিত রস ছেলে মেয়ের ভিন্নমূখী বিকাশে সাহায্য করে। একজোড়া জিনের একটি পিতৃকুল এবং একটি মাতৃকুল হইতে লাভ করে বলিয়া শিশু উভয় বংশের ধারাবাহিকতা বজায় রাখিতে পারে এবং তাদের প্রবনতা অর্জন করে। পিতা-মাতার আকৃতি প্রকৃতিগত বৈসাদৃশ্যের ফলে সন্তান তাহাদের দেহকোষে বিপরীতধর্মী জিন লাভ করে। বিপরীতধর্মী জিনের একটি সবল এবং অপরটি দূর্বল হয়। ফলে সবল জিনটি প্রভাব বিস্তার করে। সেজন্যই দেখা যায় যে, সন্তানের জীবকোষের সবল জিনগুলিই তার আকৃতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করিয়া থাকে বলিয়াই পূর্বপুরুষদের সঙ্গে কিছুনা কিছু সাদৃশ্য থাকে; অবিকল এক রকম হয়না। উল্লেখ্য যে, সংকর জাতের শিশুদের বেলায় বিপরীতধর্মী জিন লাভের সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি। কাজেই সন্তানের সঙ্গে পিতা-মাতা পূর্বপুরুষদের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যের মূলে জিনের প্রভাব অপরিসীম। সার কথা হল,- প্রত্যেকের দেহে জিনের বিন্যাস সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন হইয়া থাকে। তাই প্রত্যেক পিতা-মাতার সন্তানদের বংশগতি সাধারনভাবে একরূপ হইলেও সকলের বংশগতি এক নয়। প্রত্যেকটি শিশুর বংশগতি একান্তভাবেই তাহার নিজস্ব। তাই মানুষে মানুষে এত পার্থক্য

বিজ্ঞানীদের মতে- মাতৃগর্ভে ভ্রূণের প্রথম সঞ্চার তথা জীবকোষ সৃষ্টির সাথে সাথেই শিশুর পরিবেশ আরম্ভ হয়। পরিবেশকে প্রথমতঃ দুইভাগে বিভক্ত করা হয়,- জন্মের পূর্ববর্তী পরবর্তী। জন্মের পূর্ববর্তী পরিবেশকে আবার তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়। যথা- কোষাভ্যন্তরীণ, আন্তকৌশিক সাধারন। জন্মের পরবর্তী পরিবেশকে দুইভাগে বিভক্ত করা হয়, ব্যক্তিগত বস্তুগত। কোষাভ্যন্তরীণ পরিবেশ বলিতে কোষের মধ্যে অবস্থিত ক্রোমোজোম পরিবৃত্ত সাইটোপ্লাজম (Cytoplasm) কে বুঝায়। আন্তকৌশিক পরিবেশ হইল কোষ সমূহের পারস্পরিক প্রভাব। জন্মের পূর্ববর্তী সাধারন পরিবেশ বলিতে সেই তরল পদার্থকে বুঝায় যাহা ভ্রূণের চারিপাশে এবং রক্ত অক্সিজেনের মধ্যে অবস্থিত

জন্মের পরবর্তী পরিবেশ শিশুর জন্মের পরক্ষণ থেকেই আরম্ভ হয়। একই পরিবারের দুইজনের পরিবেশ স্থূলভাবে এক হইলেও প্রকৃতপক্ষে এক নয়। বস্তুগতভাবে পরিবেশ এক হইলেও ব্যক্তিগতভাবে একই পরিবেশের বিভিন্ন দিক বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে বিভিন্নভাবে হাজির হয়। তাই একই পিতা-মাতার বিভিন্ন সন্তান স্বতন্ত্র বা বিপরীত প্রকৃতির হয়ে থাকে। অনুকুল পরিবেশে ব্যক্তির সুপ্ত শক্তি সম্ভাবনা বিকশিত হয়। প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন ব্যক্তির উপর ক্রিয়া করিয়া তাকে কর্মঠ বা আয়াসী, শক্তিশালী বা দূর্বল, পরিশ্রমী বা অলস করিয়া তোলে; সামাজিক পরিবেশও তেমনি ব্যক্তির বিভিন্ন গুণ ক্রিয়া সম্পাদনে সাহায্য করিয়া তাহার শক্তির স্বাভাবিক বিকাশে অবদান রাখে। মূলতঃ শিশুর ভাবী ব্যক্তিত্বের কাঠামো তাহার পারিবারিক পরিবেশেই রূপ লাভ করিয়া থাকে। বংশগতির ফলে যে সমুদয় দোষ-গুণের অধিকারী হয় পরিবেশের প্রভাবেই উহাদের সম্যক বিকাশ ঘটে

সার কথা হল- শিশু কোন না কোন পরিবেশে জন্মগ্রহণ করে এবং বেড়ে ওঠে বংশগতি পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের জন্যই বংশগতিকে জন্মগত উত্তরাধিকার(Biological Heritage) এবং পরিবেশকে সামাজিক উত্তরাধিকার (Social Heritage) বলে

আমি মনেকরি, সেই গর্ভধারনকালে স্থানীয়ভাবে গ্রহ-নাক্ষত্রিক প্রভাব দ্বারা পিতা-মাতা প্রভাবিত হয় বলে প্রভাবানুযায়ী জিনবিন্যাস হয়ে থাকে ভ্রূণে। তার প্রভাবেই জীবনের ভিত গঠিত হয়। পরবর্তীতে ভূমিষ্ঠকালে যখন শিশুর নাভীরজ্জু (Umbilical Cord) কর্তিত হয় তখনকার স্থানীয় গ্রহ-নাক্ষত্রিক প্রভাব দ্বারা যে প্রভাবিত হয় পরোক্ষভাবে সেই প্রভাবেই জীবন কাটে। জ্যোতিষবিদ্যা সেই প্রভাব বিশ্লেষণের চর্চ্চা করে। গর্ভকালের প্রভাব নিয়ে কোন কথা বলেনা। আমি আরও মনেকরি, যদি গর্ভধারনক্ষণ সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয় তাহলে সে বিষয়েও পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব। আশাকরি আগামীতে প্রযুক্তির সহায়তায় সঠিক গর্ভধারনক্ষণ নির্ণয় করে সে বিষয়েও পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব হবে