কথাটি দৈববাণী (Prophecy) নাকি ভবিষ্যদ্বাণী (Prediction) কোনটি বেশি সঠিক প্রথমে তা নির্ণিত হওয়া উচিত। Edgar
Cayce I Ching আমার মতে দৈববাণী শব্দটির সাথে ধর্মের সম্পর্ক আছে আর ভবিষ্যদ্বাণী শব্দটি পার্থিব, তাই ভবিষ্যদ্বাণী শব্দটিই বেশি গ্রহনযোগ্য। আর এই শব্দটি সুপ্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। দৈববাণী বললে বুঝায় দৈব বা অজ্ঞাত অদৃশ্য কোন সূত্র থেকে প্রাপ্ত কোন বাণী, আর ভবিষ্যদ্বাণী শব্দটির কাজটি আমরা বুঝি যে, কোন বিষয়ে আগাম মন্তব্য করা। কিন্তু কিভাবে এই কাজটি সম্পাদিত হয় তা হয়ত সকলে বুঝিনা। তাই এ বিষয়ে কৌতুহল থাকাটাই স্বাভাবিক। এই কৌতুহল নিবৃত্তের প্রয়াশে বিভিন্ন বই পত্র-পত্রিকা মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যসূত্রে বর্ণিত বিষয়াবলীর আলোকে এই আলোচনা।
যদি কেউ আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপনাস্ত্রের গতিপথ বা পরের দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলতে পারে তাকে কি ভবিষ্যদ্বক্তা বলা যায় ? না বলা যায়না। কারন, বিজ্ঞানের বদৌলতে প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় কম্পিউটার এখন তা বলে দেয় বলে আমাদের শব্দ ব্যবহারেও যুগোপযোগী পরিবর্তন এসেছে। আর এই পরিবর্তনের ফলেই হয়ত ভবিষ্যদ্বাণী করা নিয়ে আজ আর কেউ তেমন প্রচেষ্টা চালাচ্ছেনা। কিন্তু একদিন ভবিষ্যদ্বক্তারা সারা পৃথিবী ব্যাপী সুপরিচিত ছিলেন, সমাদৃত ছিলেন। তাদের ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে সারা পৃথিবী ব্যাপী তোলপাড় হয়েছে। আমাদের কৌতুহল কিভাবে তারা সেসব করেছেন ?
এ যাবত জানা ব্যাপার গুলির মধ্যে ধর্মীয় ব্যাপার গুলি অপার্থিব তথা দৈব এবং তা নিয়ে আমি কোন আলোচনায় যাবনা, কেননা অপার্থিব বিষয় নিয়ে এই আলোচনা নয়। এর বাহিরে যে ব্যাপার গুলি জানা যায়, যেসব ভবিষ্যদ্বাণী বা ভবিষ্যদ্বক্তার কথা জানা যায়, তারা কিভাবে সেইসব ভবিষ্যদ্বাণী করতেন আলোচনার বিষয় মূলতঃ তাহা।
সর্বপ্রথম কথা হল- ইসলাম ধর্মে ভবিষ্যদ্বাণী করা হারাম বা নিষিদ্ধ। ইসলামী বিশ্বাস মতে ভবিষ্যৎ একমাত্র আল্লাহ্ তায়ালাই জানেন, কোন সৃষ্টির পক্ষেই তাহা জানা সম্ভব নয়। আমিও তাতে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি এবং একমত। প্রশ্ন হতে পারে, তাহলে ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে, ভবিষ্যদ্বক্তা নিয়ে কথা হচ্ছে কেন ? কথা হচ্ছে এ জন্য যে, এ বিষয়টি সবার কাছে পরিষ্কার নয় যে (ধর্মীয় ভাবে) যেটিকে ভবিষ্যদ্বাণী বলা হচ্ছে তা মূলতঃ মানুষের তাকদীরের অংশবিশেষ, একশ্রেণীর ভবিষ্যদ্বক্তা হয়ত তাহাই প্রতিফলিত করতে চেয়েছেন, কিন্তু তা ঠিক নয়, সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারনামাত্র। সাধারণ মানুষও অজ্ঞতাবশতঃ তা বিশ্বাস করে ঈমানহারিয়েছেন। ভবিষ্যদ্বক্তারা হয়ত সাময়িক লাভবান হয়েছেন এবং তাদের অনেক ভবিষ্যদ্বাণীও হয়ত ফলেছে। কিন্তু, কোন ভবিষ্যদ্বক্তার কোন ভবিষ্যদ্বাণীইযে “লাউহে মাহফুজে সংরক্ষিত তাকদীর” নয়, বরং একটি অতিন্দ্রীয় উপলব্দিমাত্র (Extra Sensory Perception) সেটি প্রমান করার জন্যই এই আলোচনার অবতারনা।
এ জন্যই জানতে হবে তারা কিভাবে সেইসব ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন ? আমি এ সকল বিষয়ে যতটুকু পড়েছি জেনেছি ভাবনা চিন্তা করে পেয়েছি তাতে দেখেছি, বিভিন্ন জন বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। কেউ কেউ দৈববাণী অর্জনের অধিবেশন (Prophetic Session) এর মাধ্যমে, কেউ কেউ স্বপ্নে অগ্রজ্ঞান (Precognitive) অর্জনের মাধ্যমে, কেউ কেউ অন্তর্দৃষ্টির (Vision) মাধ্যমে, কেউ কেউ রহস্যোদ্ঘাটনের (Revelation) মাধ্যমে, কেউ কেউ মোহাবস্থার (Trance) মাধ্যমে, কেউ কেউ আত্মিকপাঠের (Psychic Reading) মাধ্যমে মোহাবস্থায় গিয়ে, কেউ কেউ দৃষ্টিভ্রমের মাধ্যমে, কেউ কেউ আত্মপ্ররোচিত ভাবে মোহাবস্থায় গিয়ে, আবার কেউবা মন জানাজানির (Telepathy) মাধ্যমে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। আরেকটি শ্রেণী ছিল শয়তানের পূজারী তান্ত্রিক ভবিষ্যদ্বক্তা যারা শয়তানের সাহায্যে এ কাজটি করত। এ সবের কোনটির সাথেই লাউহে মাহফুজে সংরক্ষিত তাকদীরের কোনই সম্পর্ক ছিলনা। কেউ তা দাবীও করেনি।
যেমন,- ষষ্ঠদশ শতাব্দীর ফরাসী দার্শনিক চিকিৎসক ও বিখ্যাত ভবিষ্যদ্বক্তা মাইকেল ডি নস্ত্রাদামাস (Michel de Nostradamus) “সেঞ্চুরী” নামক পুস্তকে ৯৪২টি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। মোট ১০টি সেঞ্চুরী ছিল। ৭ম টিতে ৪২টি, বাকী ৯টিতে ১০০টি করে ভবিষ্যদ্বাণী ছিল। আর সেগুলি সবই ছিল ছন্দাকারে রচিত। জুলিয়ান ক্যালেণ্ডার অনুযায়ী ১৫০৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর এবং জর্জিয়ান ক্যালেণ্ডার অনুযায়ী ২৩ ডিসেম্বর দূপুরে ফ্রান্সের সেইন্ট রেমি ডি প্রোভেনস (St. Remy de Provence) এ নস্ত্রাদামাসের জন্ম এবং ১ জুলাই ১৫৫৬ (সন নিয়ে মতভেদ আছে) নিজ ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী তার মৃত্যু হয়।
নস্ত্রাদামাস যে পদ্ধতি অনুসরন করে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন- সেটি ছিল মোহাবস্থা। এ কাজে তিনি তামার তেপায়ার ওপরে বসানো এক গামলা পানির প্রতি মনোনিবেশ করতেন। এ ব্যবস্থাকে আত্মপ্ররোচিত মোহাবস্থা বলা যেতে পারে। মোহগ্রস্ত অবস্থায় নস্ত্রাদামাস সেঞ্চুরীর পদ্য গুলি লিখেন। প্রাচীন ভবিষ্যদ্বক্তা ডেলফিক ওরাকল আর নস্ত্রাদামাসের পদ্ধতি একই ছিল।
নস্ত্রাদামাসের জন্মের পূর্বে ফ্রান্সে লুক গরিক নামে একজন ছিলেন এবং দ্বাদশ শতাব্দীর আইরিশ ভবিষ্যদ্বক্তা ম্যালাচি মোহাবস্থায় ভবিষ্যদ্বাণী করতেন। অতীতে গ্রীক ভবিষ্যদ্বক্তা ওরাকল অব ব্রাঞ্চাস এবং চতুর্থ শতাব্দীর নব্য প্লেটোবাদী ইয়ামব্লিকাস (Iamblichus) এর পদ্ধতি অনুযায়ী কাজ করতেন নস্ত্রাদামাস। অতি সাম্প্রতিক অ্যালিয়েস্টার ক্রাউলিও মোহাবস্থায় ভবিষ্যদ্বাণী করতেন। ইতিহাসে আরো বহু নাম পাওয়া যাবে যারা মোহাবস্থায় ভবিষ্যদ্বাণী করতেন। এখনও অঞ্চল বিশেষে শোনা যায় কেউ কেউ এ পদ্ধতিতে কাজ করেন।
ভবিষ্যদ্বক্তাদের কারো কারো রোগ নির্ণয় ও তার নিরাময় করারও ক্ষমতা ছিল। বিশেষকরে নস্ত্রাদামাসের। নস্ত্রাদামাসের আরও একটি বিশেষ ক্ষমতা ছিল (পিছন দিকে চলা) ভবিষ্যদ্বাণী করা। যা তার জীবদ্দশায় বা পূর্বে ঘটেছে। এ জন্য নস্ত্রাদামাসই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভবিষ্যদ্বক্তা। আজও নস্ত্রাদামাসকে নিয়ে লেখালেখি বা গবেষণার শেষ নেই।
সাম্প্রতিক কালের আরেকজন বিশ্ববিখ্যাত আমেরিকান ভবিষ্যদ্বক্তা মিসেস জিন ডিকসন, তিনিই টেলিপ্যাথিকে জনপ্রিয়তায় এনেছেন। এটি একটি মন জানাজানির পদ্ধতি। তিনি অন্তর্দৃষ্টি এবং রহস্যোদ্ঘাটন নিয়ে কাজ করেন। এই দুটোকে আলাদাভাবে চিহ্নিতও করেছেন তিনি। পরেরটি অবশ্যম্ভাবী, প্রথমটি নয়। তবে দুটোই ভবিষ্যত বলা।